স্পর্ধানিউজ প্রতিদিন অনলাইনঃ
এ-কালের কবিদের আমরা প্রায়শই আড্ডা দিতে দেখি। আড্ডা কি কবিতার কোনো উপকার করে? কবি আল মাহমুদ আমাকে একাধিকবার বলেছেন, তোমাকে বুঝতে হবে কখন আড্ডা ছেড়ে উঠে আসতে হয়, কখন লেখায় বসে পড়তে হয়। কবি শহীদ কাদরী আমার সঙ্গে এক আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকারেই বলেছিলেন, শামসুর রাহমান আমাকে বলেছিলেন, শহীদ আড্ডা ছেড়ে উঠে আসুন, নাহলে কবিতা চলে যাবে। কিন্তু আমি উঠে আসিনি। কথাটি শহীদ কাদরী বেশ আক্ষেপ করেই বলেছিলেন। এর ফল তো আমরা জানিই, কবিতার এতো শক্তিশালী একটি হাত, কত দ্রুতই তা গুটিয়ে গেল।
আড্ডা কখনো কখনো ড্রাগের মতো নেশায় পরিণত হয়। নেশার ক্ষতিকর দিক তো আমরা জানিই। কেবল একটি নেশাই উপকারী, সেটা হলো যার যা কাজ তার নেশায় মশগুল থাকা। যেমন বিজ্ঞানী থাকবেন আবিস্কারের নেশায়, কবি থাকবেন কাব্য-সাধনার নেশায়। এই নেশার কোনো ক্ষতি নেই, আর সব নেশাই ক্ষতিকর।
আপনি কার সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছেন সেটিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টি যদি পদার্থবিদ্যার “Interference” এর সূত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করি তাহলে হয়ত সহজ হবে। ধরেন যদি দুটি দানবাকৃতির ঢেউ দুদিক থেকে এসে পরস্পরকে ধাক্কা দেয় তাহলে কী হবে? আরো বড়ো একটি ঢেউ তৈরি হবে, প্রবল একটি শক্তি তৈরি হবে। কিন্তু যদি একটি দশ ফুট উঁচু ঢেউ একটি এক ফুট উঁচু ঢেউকে ধাক্কা দেয় তাহলে কী হবে? এক ফুটকে নিয়ে দশফুট ভেঙে পড়বে। দুটোই হারিয়ে যাবে। কোনো শক্তিই তৈরি হবে না।
আড্ডার বিষয়টিও এরকম। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ যে আপনি কার সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছেন। আপনি যদি চিন্তার ও সক্ষমতার দিক থেকে আপনার সমপর্যায়ের কবির বা কবিদের সঙ্গে আড্ডা দেন তাহলে সেই আড্ডা শক্তি উৎপাদন করবে, সকল পক্ষকেই তা সমৃদ্ধ করবে। যদি খুব বেশি অসম কারো সঙ্গে আড্ডা দেন তাহলে পরস্পরের মধ্যে বিনিময় হয়ত হবে, সেখান থেকে নতুন কোনো শক্তি উৎপাদন হবার সম্ভাবনা কম থাকবে। কারণ এক আর দশের মধ্যে সংঘর্ষ হবে না। ফলে এক দশের মধ্যে বিলীন হয়ে যাবে, স্বাতন্ত্র হারাবে, যদি কোনো কারণে স্বাতন্ত্র নিয়ে বের হয়ে আসতেও পারে বড়ো জোর তিনি দুই, তিন বা চারে উন্নীত হতে পারবেন। দশের কোনো উন্নতিই এক্ষেত্রে হবে না। কিন্তু দুটো দশ যদি আড্ডা দিতে বসে সেখানে সংঘর্ষ হবে এবং সেই সংঘর্ষ থেকে উৎপাদিত শক্তি দুজনকেই ১১, ১২, ১৩তে উন্নীত করবে। পৃথিবী নতুন শক্তির সন্ধান পাবে।
তবে অবশ্যই এর ব্যতিক্রম আছে। কারণ আমরা কথা বলছি সফট পাওয়ার নিয়ে, ফিজিক্সের মত অনুভূত কোনো বস্তু নিয়ে নয়। এক্ষেত্রে কেউ কেউ আছেন নিজে দশ হওয়া সত্বেও এক-এর অস্তিত্বকে ভেঙে তার ভেতর থেকে মণি-মানিক্য তুলে আনতে পারেন। কোনো কোনো একও এমন আছেন, দশের সামনে ভীত না হয়ে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন, যে ধাক্কায় দশ কেঁপে ওঠেন এবং সেই কম্পন থেকে তৈরি হয় নতুন তরঙ্গ।
তবে মূল কথা হচ্ছে আড্ডা থেকে আমাদের সর্বদাই কিছু আহরণের চেষ্টা করতে হবে, অন্বেষাকে সক্রিয় রাখতে হবে এবং আহরিত কাচামাল দিয়ে তৈরি করতে হবে নতুন ইমারত।
কাজী জহিরুল ইসলাম
হলিসউড, নিউইয়র্ক।