স্পর্ধা নিউজ প্রতিদিন ।। অনলাইন ডেস্ক।।
আজ ঐতিহাসিক ১০ই এপ্রিল। ১৯৭১ সালের এইদিনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠনের দিন। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার ভিত্তিতে দেশকে হানাদার পাকিস্তানিদের দখলমুক্ত ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করতে এইদিনে প্রথমে স্বাধীনতার ‘ঘোষণাপত্রে’ গ্রহণ করা হয়। এর আলোকে গঠন করা হয় বাংলাদেশের প্রথম সরকার, যা প্রবাসী সরকার বা মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি করে ছয় সদস্যের মন্ত্রিসভা ঘোষণা করা হয়।
প্রথম সরকারের সদস্যগণ ছিলেন-
১. রাষ্ট্রপতি (সরকার প্রধান)- শেখ মুজিবুর রহমান।
২. উপরাষ্ট্রপতি- সৈয়দ নজরুল ইসলাম (অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন)।
৩. প্রধানমন্ত্রী- তাজউদ্দীন আহমেদ।
৪. অর্থমন্ত্রী- ক্যাপ্টেন মনসুর আলী।
৫. স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী- এ এইচ এম কামরুজ্জামান।
৬. পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী- খন্দকার মোশতাক আহমদ।
১১ই এপ্রিল কর্নেল (অব.) এমএজি ওসমানীকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বাঁ প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ ১১ই এপ্রিল বেতার ভাষণে সরকার গঠন ও মন্ত্রিসভার ঘোষণা দেন।
১৭ এপ্রিল ১৯৭১ মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা (বর্তমান উপজেলা মুজিবনগর) গ্রামের আম্রকাননে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণ করে।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল, সাড়ে সাত কোটি জনগণ নিয়ে পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয় নতুন একটি রাষ্ট্র, বাংলাদেশ। এদিন মেঘযুক্ত আকাশ ও নির্মল বাতাসে সহস্র কণ্ঠে জয়ধ্বনি উঠেছিল “জয় বাংলা, বাংলার জয়”। পরাধীনতার শিকল ছিড়ে মুক্তি পায় বাঙালি জাতি।
মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ মুক্তিযুদ্ধে ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে ভারতীয় ও বিদেশী সাংবাদকর্মীর উপস্থিতিতে এই আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয় তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈধ্যনাথতলার আম্রকাননে। শপথ পরিচালনা করেন জেলা প্রশাসক ও ম্যাজিস্ট্রেট (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী’র বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা) তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। এরপর মুক্তিফৌজ হিসেবে পরিচিত একদল মুক্তিযোদ্ধা পুলিশ কর্মকর্তা মাহবুব উদ্দিনের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভার সদস্যদের গার্ড অব অনার প্রদান করেন।
তার কিছুদিন আগে ১০ এপ্রিল তাজউদ্দিন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী করে চার সদস্য বিশিষ্ট মন্ত্রীসভার ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ সরকার গঠিত হয়। যে সরকারের রাষ্ট্রপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং উপ রাষ্ট্রপতি (অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি) সৈয়দ নজরুল ইসলাম। তাছাড়া খন্দকার মোশতাক আহমেদ, ক্যপ্টেন মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য এবং অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল এ জি এম ওসমানীকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয় এর দায়িত্ব দেয়া হয়, যিনি পরবর্তীতে মুক্তি বাহিনীর সর্বাধিনায়ক কমান্ডার-ইন-চিফ হন।
যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরী হলে, ভারত সরকারের সহযোগীতা নেবার কথা আগেই জানিয়ে রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। এই নির্দেশনা মেনেই বঙ্গবন্ধুর প্রতিনিধি হিসেবে দুই এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির সাথে বৈঠক করেন তাজউদ্দিন আহমেদ। আলোচনা ফলপ্রসূ হলেও তিনি উপলব্ধি করেন আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্যতা পেতে হলে একটি সরকার গঠন এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রয়োজন। এতে করে যুদ্ধের সহযোগিতাসহ একটি স্বাধীন দেশে পাকিস্তান আক্রমন করেছে এই বিষয়টি বিশ্ববাসীকে বোঝানোও ভারতের পক্ষে সহজ হবে। তারই প্রেক্ষিতে তৎকালীন আওয়ামীলীগ নেতা ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম আইনের ভাষায় ইংরেজিতে এই ঘোষনাপত্র লিখেন এবং পরবর্তীতে মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়।
মূলত মুজিবনগর সরকারের ঘোষনাপত্রটি ছিলো নবগঠিত সরকারের অস্থায়ী সংবিধান। বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পর প্রথম গণপরিষদ অধিবেশনে মুজিবনগর সরকারের ঘোষণা পত্রের সাথে একাত্মতা জানিয়ে ১৯৭২ এর ২৩মে বাংলাদেশ সরকারের গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় এটি প্রকাশ করেন। এমনকি বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদের ২ নম্বর তফসিলে বলা হয়েছে, ‘১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তারিখে মুজিবনগর সরকারের জারীকৃত স্বাধীনতার ঘোষনাপত্র হইলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিসংগ্রামের ঐতিহাসিক ভাষন ও দলিল, যাহা উক্ত সময়কালের জন্য ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধান বলিয়া গণ্য হইবে।’
কাজী সালমা সুলতানা
লেখক ও অনলাইন এক্টিভিস্ট