স্পর্ধা নিউজ প্রতিদিন আন্তর্জাতিক ডেস্ক।।
প্রয়াত পৃথিবীর দরিদ্রতম রাষ্ট্রপ্রধান হোসে মুজিকা (৮৯)। উনি ছিলেন উরুগুয়ের ৪০তম রাষ্ট্রপতি। সম্পত্তি বলতে ছিল কেবল পুরানো আমলের ছোট্ট গাড়ি আর একটি জরাজীর্ণ বাড়ি। হোসে মুজিকা দেশের রাষ্ট্রপতি হয়েও কোনদিন রাষ্ট্রপতি ভবনে বসবাস করেননি। ওই ভাঙাচোরা ঘরে তিনি, ওনার স্ত্রী আর ম্যানুয়েলা নামের তিন পেয়ে একটি কুকুর থাকতেন। উরুগুয়ের মানুষ তাঁকে ভালোবেসে ডাকতেন ’পেপে’।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে পেতেন ১২,৫০০ মার্কিন ডলার বেতন পেতেন। বেতনের মাত্র ১০ শতাংশ তিনি নিতেন আর বাকিটা দান করে দিতেন।
প্রথম জীবনে, হোসে মুজিকা ছিলেন একজন টুপামারো গেরিলা। এই বামপন্থী গেরিলারা ধনীর সম্পদ লুন্ঠন করে গরীবের মাঝে বন্টন করতো। তিনি ৬বার পুলিশের হাতে গুলিবিদ্ধ হন। এর মধ্যে ১৯৭২ সালে গুরুত্বর আহত হন। জেলে থেকেছেন ১৪ বছর। মার্কিনী মনিবদের নির্দেশে জেলের ভিতর সহ্য করতে হয়েছে অমানুষিক অত্যাচার।
রাষ্ট্রপতি হিসাবে তাঁর ছিল না কোন প্রটোকল, ছিল না কোনো গাড়ির বহর। রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার আগেও কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন, হওয়ার পরেও স্ত্রীকে সঙ্গে করে চালিয়ে গেছেন কৃষিকাজ। রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে বিমানে চড়লেও কোনোদিন প্রথম শ্রেণীতে চড়েননি, চড়েছেন ইকোনমি ক্লাসে।
১৯৮৫ সালে উরুগুয়েতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর তিনি জেল থেকে মুক্তি পান। যোগ দেন সংসদীয় বাম রাজনীতিতে। ১৯৯৪ সালে তিনি সেনেটর নির্বাচিত হন। ২০০৫ সালে মন্ত্রী আর ২০১০ এ রাষ্ট্রপতি।
হোসে মুজিকা উরুগুয়ের দূর্বল অর্থনীতিকে একটি শক্তিশালী জায়গায় পৌঁছে দিয়েছিলেন।
একটি ক্যাথলিক দেশে সব বাধা উপেক্ষা করেই সমলিঙ্গের বিবাহ, গর্ভপাতের মতো বিষয়গুলোরও বৈধতা দেন হোসে মুজিকা।
বিদায় হোসে মুজিকা: বিশ্বের দরিদ্রতম প্রেসিডেন্ট
—————————————————-
আজ এই নির্লোভ অনন্য ও মহান মানুষটি হানাহানি ও স্বার্থপরতা উৎকট ক্ষমতাবাজির মাটির পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। যে মে মাসে তিনি এই পৃথিবীতে এসেছিলেন সেই মে-তেই তিনি বিদায় নিলেন কমরেড মুজিকা। তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক ও আনত শ্রদ্ধাঞ্জলি।
আসুন জেনে নেওয়া যাক কমরেড মুজিকা সম্পর্কে :
আধুনিক বিশ্বে রাজনীতি হচ্ছে ক্ষমতার দম্ভ, অহঙ্কার, বিলাসিত ও সম্পদের পাহাড় ও সাম্রাজ্য বিস্তার। কিন্তু এই ধারা ভেঙ্গে বিশ্বজুড়ে এক ব্যতিক্রমী নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন, তিনি হচ্ছেন হোসে আলবার্তো মুজিকা কর্দানো, সংক্ষেপে হোসে মুজিকা, উরুগুয়ের ৪০তম রাষ্ট্রপতি যিনি বিশ্বের দরিদ্রতম প্রেসিডেন্ট হিসেবে পরিচিত। তাঁর জীবন, রাজনৈতিক দর্শন ও ব্যক্তিত্ব তাঁকে অনন্য করে তুলেছে আধুনিক বিশ্বের রাজনীতিকদের মধ্যে।
হোসে মুজিকা জন্মগ্রহণ ১৯৩৫ সালের ২০ মে, উরুগুয়ের রাজধানী মন্টেভিডিওতে। তাঁর পরিবার ছিল এক সাধারণ কৃষিজীবী। শৈশব থেকেই তিনি অভাব-অনটন দেখে বড় হয়েছেন। এই জীবন-সংগ্রাম তাঁকে তৈরি করেছিল এক অন্যরকম নেতায়, যাঁর কাছে রাজনীতি ছিল আক্ষরিক অর্থেই সেবা ও আত্মত্যাগের বিষয়।
১৯৬০-এর দশকে হোসে মুজিকা যুক্ত হন “টুপামারোস” (Tupamaros) নামে একটি বামপন্থী গেরিলা সংগঠনের সঙ্গে। যে সংগঠনটি সামাজিক অসাম্য ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল।
* গেরিলান্দোনের আন্দোলনের অংশ হিসেবে ব্যাংক লুট, অস্ত্র চুরি, ধনী শ্রেণির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর ১৯৮৫ সালে তিনি নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে যুক্ত হন।
# রাষ্ট্রপতি হওয়া সত্ত্বেও হোসে মুজিকা কখনও প্রেসিডেন্ট ভবনে থাকেননি। বরং তাঁর ছোট খামারবাড়িতে স্ত্রী লুসিয়া টোপোলানস্কির সঙ্গে বসবাস করতেন।
# তিনি নিজের খাবার নিজে রান্না করতেন,
# পুরনো একটি ভক্সওয়াগন বিটল গাড়ি চালাতেন এবং
# রাষ্ট্রপতির বেতনের ৯০% দান করতেন দরিদ্রদের সহায়তা ও সামাজিক উন্নয়নে।
এই অনাড়ম্বর জীবনযাপন তাঁকে জনসাধারণের চোখে একজন নেতা নয়, বরং দানশীল এক বন্ধু ও অভিভাবকে পরিণত করে। তাঁর এই সাদামাটা জীবন ও মানবিক চিন্তাধারা বিশ্বজুড়ে প্রশংসা কুড়ায়। অনেকেই তাঁকে
# “ফিলোসফার প্রেসিডেন্ট” বা দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক বলে অভিহিত করেছেন।
হোসে মুজিকার শাসনামলে
*তিনি সবসময়ে বলতেন, ”উন্নয়ন মানে শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয়, বরং মানুষের মৌলিক অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করা।”
হোসে মুজিকার দর্শন ছিল স্পষ্ট— সত্যিকারের স্বাধীনতা আসে আত্মসংযম থেকে। তিনি বিশ্ববাসীর কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা রেখেছেন: “আমি গরিব নই। গরিব সে, যার চাহিদা অনেক এবং তা পূরণ করতে পারে না। আমি অল্পতেই তুষ্ট, এটাই আমার সম্পদ, এটাই আমার স্বাধীনতা।” এই দর্শনের মাধ্যমে তিনি ভোগবাদী সমাজকে আঘাত করেছেন এবং প্রমাণ করেছেন যে একজন নির্লোভ সৎ মানুষও দক্ষভাবে রাষ্ট্র চালাতে পারে। তিনি উন্নয়নের নামে ভোগবাদ, বিলাসিতা ও আতিশয্যের ঘোড় বিরোধী ছিলেন। তাঁর কথা ও কাজে ফুটে ওঠে অভিন্ন বাস্তবতার এক গভীর মানবিক জীবনবোধ। যে কারণে হোসে মুজিকার চিন্তাধারা শুধু উরুগুয়েতে নয়, সারা বিশ্বেই আলোচনার কেন্দ্রতে ছিল।
হোসে মুজিকার জীবন আমাদের শেখায়— নেতৃত্ব মানে রাজকীয়তা নয়, বরং আত্মত্যাগ, সততা ও প্রকৃত জনসেবা। তিনি শুধু একজন রাষ্ট্রপতি ছিলেন না, ছিলেন এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা। মুজিকার জীবন কেবল রাজনৈতিক শিক্ষাই নয়, বরং মানবিকতার পাঠশালা। আধুনিক বিশ্বের ক্ষমতালোভী রাজনীতির মাঝে তিনি এক অনন্য আদর্শ।
আজ এই নির্লোভ অনন্য ও মহান মানুষটি হানাহানি ও স্বার্থপরতা উৎকট ক্ষমতাবাজির মাটির পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। যে মে মাসে তিনি এই পৃথিবীতে এসেছিলেন সেই মে-তেই তিনি বিদায় নিলেন কমরেড মুজিকা। তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক ও আনত শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সংগ্রহ ও সম্পাদনা :
হাফিজ সরকার
লেরকারখক ও কলামিস্ট