স্পর্ধা নিউজ প্রতিদিন প্রতিবেদক।।
বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পরিসরে সম্প্রতি এক উত্তাল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫-কে কেন্দ্র করে। গত ২৩ মে থেকে সচিবালয়ের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ধারাবাহিকভাবে কর্মবিরতি, অবস্থান কর্মসূচি ও প্রতিবাদে অংশ নিচ্ছেন। তাদের অভিযোগ—সরকার যে নতুন অধ্যাদেশ জারি করেছে, তা রাষ্ট্রীয় চাকরিজীবীদের সাংবিধানিক অধিকারকে লঙ্ঘন করছে এবং এটি মূলত একটি দমনমূলক আইন।
এই অধ্যাদেশে কিছু নতুন ধারা সংযুক্ত করা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে যে, কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকা, সহকর্মীদের আন্দোলনে উৎসাহ দেওয়া, শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করা বা দায়িত্ব পালনে বাধা সৃষ্টি করা—এই চারটি কর্মকাণ্ড গুরুতর শৃঙ্খলাভঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হবে। এর শাস্তি হিসেবে চাকরি থেকে অপসারণ, বরখাস্ত কিংবা নিম্নপদে অবনমনের বিধান রাখা হয়েছে। ফলে এ আইনের প্রেক্ষিতে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী যে কোনো কর্মচারী চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। এমন কঠোর বিধানের ফলে সচিবালয়ের অভ্যন্তরে আতঙ্ক, ক্ষোভ এবং অনাস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
সরকারি প্রচারমাধ্যমের দাবি, এই অধ্যাদেশ মূলত প্রশাসনে শৃঙ্খলা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য প্রণীত হয়েছে। সরকার এটিকে একটি ‘প্রশাসনিক সংস্কার উদ্যোগ’ হিসেবে ব্যাখ্যা দিচ্ছে এবং বলছে, এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া না হলে নাগরিক সেবায় স্থবিরতা সৃষ্টি হয়। কিন্তু এই ব্যাখ্যা কতটা গ্রহণযোগ্য—তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, কারণ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কোনো পূর্বপরামর্শ বা অংশগ্রহণমূলক আলোচনা ছাড়াই অধ্যাদেশটি জারি করা হয়েছে। এ কারণে বিষয়টি একতরফা সিদ্ধান্ত ও ক্ষমতার অপব্যবহারের ইঙ্গিত দেয়।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার দিক থেকেও এই পরিস্থিতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-র নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ একদিকে সরকারি দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বলেছেন, “আমরা রক্ত দিচ্ছি আর ওরা সচিবালয়ে বসে টাকা ভাগ করছে।” অপরদিকে তিনি সচিবালয় কর্মচারীদের আন্দোলনকে ‘স্বৈরাচারী ষড়যন্ত্র’ বলেও আখ্যায়িত করেছেন এবং এটিকে অন্তর্বর্তী সরকারের কাজে বাধা সৃষ্টি বলেও উল্লেখ করেছেন। এই দ্ব্যর্থক বক্তব্যে তার রাজনৈতিক অবস্থান অস্পষ্ট হয়ে ওঠে। যখন এক নেতা একইসঙ্গে প্রশাসনের দুর্নীতির নিন্দা করেন এবং সেই প্রশাসনের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের আক্রমণ করেন—তখন তার গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নিয়েই প্রশ্ন উঠে।
আইন বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই অধ্যাদেশ বাংলাদেশের সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকার—বিশেষ করে মতপ্রকাশ ও সংগঠনের স্বাধীনতার পরিপন্থী। বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০১৮ সালের সরকারি চাকরি আইনের কিছু ভারসাম্যপূর্ণ দিক এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে ব্যাহত হয়েছে। শাস্তির মাত্রা অত্যন্ত কঠোর এবং এর প্রয়োগ হলে যে কেউ বিনা বিচারে চাকরি হারাতে পারেন, এমন ভয় তৈরি হয়েছে। এতে শুধু প্রশাসনের মধ্যে নয়, জনমধ্যেও সরকারের প্রতি অনাস্থা বাড়তে পারে।
গণমাধ্যম এই ইস্যুটিকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করছে। বিবিসি বাংলা, প্রথম আলো, একাত্তর টিভি, যুগান্তরসহ একাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম সচিবালয়ের আন্দোলন, সরকারি অবস্থান ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াকে বিশ্লেষণধর্মীভাবে প্রচার করছে। সংবাদমাধ্যমের এই ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ কারণ তা বিষয়টিকে একটি জাতীয় আলোচনার কেন্দ্রে এনে ফেলেছে এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
এই সংকটের মূলে রয়েছে সরকার ও কর্মচারীদের মধ্যে আস্থাহীনতা এবং প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে অংশগ্রহণের অভাব। সরকার যদি সংলাপের মাধ্যমে কর্মচারীদের উদ্বেগ ও দাবি শুনে পদক্ষেপ নেয়, তবে একটি শান্তিপূর্ণ ও যুক্তিসঙ্গত সমাধান সম্ভব। অন্যথায় এই সংকট দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক অস্থিরতায় রূপ নিতে পারে।
হাসনাত আবদুল্লাহর মতো রাজনৈতিক নেতাদের দ্বৈত বক্তব্য এবং সরকারের একতরফা সিদ্ধান্ত—এই দুই-ই গণতান্ত্রিক চর্চার স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় একটি সংবেদনশীল রাষ্ট্র শুধু শৃঙ্খলা নয়, বরং মানুষের কণ্ঠস্বর ও অধিকারকেও মূল্য দেয়। এই সংকট সেই মূল্যায়নেরই বাস্তব পরীক্ষা।
আহাদ মিনার।