স্পর্ধা নিউজ প্রতিদিন অনলাইন ডেস্কঃ
আশির দশকের শুরুতে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসি তখন আমাদের কাছে দর্শনীয় তেমন কিছু ছিল না। শুধু কার্জন হলের মাধুর্য কিছুটা টানতো। কিন্তু তা ছিল সন্ধ্যার গল্প বা বেড়ানো। কারণ, আমরা কলাভবনের ছাত্র ছিলাম। তখন কার্জন হল বা সায়েন্স ফ্যাকালটির সাথে কলাভবনের বেশ দূরত্ব ছিল। বিশেষ করে সাংস্কৃতিক। সন্ধ্যায় এই পার্থক্য কিছুটা কমতো। কার্জন হলের কেউ কেউ টিএসসির সামনে আসতো বা কেউ কেউ কার্জন হলে বন্ধু সন্দর্শনে যেতো। এমনকি দিনের বেলায় কার্জন হল থেকে রাজনৈতিক মিছিলও কলা ভবনে আসতো কিছুটা দেরিতে। আর কলাভবন চত্বর ছিল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের রাজধানী। বিশেষ করে বটতলা। বটতলার গৌরব ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় থেকে চলে আসছে। এখানে আসলে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস অগোচরে মানসপটে ভেসে আসতো। যারা রাজনীতিমনস্ক ছিল না তাদের জন্য এটা বিকেলে বাদাম খাওয়ার আনন্দ ছিল। ১৯৪৮ সাল থেকে ভাষা প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক গুরুত্ব পরম্পরায় চলে আসছিল। একারণে অনেকে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তান রাষ্ট্রকে প্রথমেই চ্যালেন্জ করেছিল যখন সমগ্র পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগের জয়জয়কার ছিল। এরপরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ব বনাম পশ্চিম পাকিস্তানের বুদ্ধিবৃত্তিক পার্থক্যকে তুলে ধরছিল। এগুলোর তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনো স্মারক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে তেমন ছিল না। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসু ভবনে ভাষা শহীদদের কিছু প্রতিকৃতি সংরক্ষণ করার প্রচেষ্টা ছিল। কিন্তু এই ভবনটা সবসময় কোনো না কোনো ছাত্র সংগঠনের হামলার শিকার হয়ে ভাঙচুর অবস্থায় থাকতো। এখানে কোনো ইতিহাসের স্মারক ছিল না, যা দেখে আমরা ইতিহাসকে অবলোকন করবো। এমনকি জাতীয় কবি খ্যাত কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবর বা তার আশেপাশে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন বা প্রফেসর আবদুল মতিনের কবরের পাশে সন্ধ্যার পর অনেকে ভয় পেতো। যত্ন ছিল না। স্বাধীনতাত্তোর কালে নানা রাজনৈতিক টানাপোড়েনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটা মারামারি বা আন্দোলনের জায়গায় পরিণত হয়েছিল; রাজনৈতিক ভাবে অগ্নিগর্ভ থাকতো কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ভাটা পড়েছিল।
আমরা পড়তে এসেছিলাম, প্রাচ্যের অক্সফোর্ডে কিন্তু তখন সত্যেন বোস বা প্রফেসর আবু মাহমুদদের যুগ ছিল না। অন্য দিকে মুক্তিযুদ্ধের তেমন কোনো স্মারক ছিল না : অপারেজয় বাংলা নামক ভাস্কর্য তৈরির আগ পর্যন্ত। কলাভবনের বটতলায় অপারেজয় বাংলা ধীরে ধীরে হয় দাঁড়াল মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় স্মারক।
রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতি ছিল বিভক্ত কিন্তু ক্যাম্পাসে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী কোনো রাজনীতি দেখিনি। তখন ছিল, সামরিক শাসন বনাম গনতান্ত্রিক আন্দোলনের মোকাবিলার রাজনীতি। রাজনীতি ধীরে ধীরে সন্ত্রাসময় হলেও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী কোনো রাজনীতি সংস্কৃতি প্রকাশ্যে ছিল না। নব্বইয়ের দশকের পর অবস্থার বিশেষ করে সরকারি রাজনীতির প্রভাব বাড়লেও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী উপাদান ছিল না। যেমন, আহমদ ছফা উদ্বিগ্ন ছিলেন শিক্ষার মান নিয়ে। লিখলেন, গাভী বৃত্তান্ত। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে যুক্তি বুদ্ধির জায়গা হিসেবে তিনি দেখতে চেয়েছিলেন। এই সময়েও ধীরে ধীরে মুক্তিযুদ্ধের স্বারকগুলো ভেসে উঠতে লাগলো। ভিসির বাংলোর সামনে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটে নিহত ছাত্র ছাত্রী, শিক্ষক, কর্মকর্তা কর্মচারী সকলের নামের তালিকা। গণকবরের স্মারক ইত্যাদি। শামীম শিকদার কিছু ভাস্কর্য তৈরি করেছিলেন যদিও এগুলোর মান তেমন উঁচু ছিল না।
টিএসসি ছিল সংস্কৃতির একটা তরঙ্গায়িত স্থান। মুক্তিযুদ্ধের নানা অনুষঙ্গ এখানে ছিল। আমাদের কাল শেষ।এখন নতুন কাল। সম্প্রতি একজন পাকিস্তানি বামপন্থী একাডেমিক বাংলাদেশে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে একটা ভিডিও আপলোড করেছেন। পাকিস্তান ভাঙনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা তুলে ধরেছেন ; কিন্তু এটা যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ ছিল তা তিনি বললেন না। তিনি অপরাজেয় বাংলা ও শহীদদের তালিকাও দেখিয়েছেন। কিন্তু তাঁর বর্ণনায় পাকিস্তানি সাংবাদিক মীরের মতো কোনো দুঃখ প্রকাশের ভাষা ছিল না। দুঃখজনক হলো তাঁর গাইড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের কয়েকজন ছাত্র নানাভাবে বলল, তারা পাকিস্তানের ক্রিকেট, নারী ও খাবার পছন্দ করেন। এগুলো দোষের কিছু নয় কিন্তু আমি প্রাচীন পন্তী, আমার চোখে ভাসছিল, জগন্নাথ হল,সার্জেন্ট জহুরুল হক হল, রোকেয়া হল, সূর্য সেন হল, ফুলার রোডে পঁচিশে মার্চ একাত্তর নিহতদের কথা। ১৪ ই ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যার কথা, গণকবরের কথা : পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুরতার কথা যা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সদস্যও লিখে গেছেন। ছাত্ররা যদি বলতো, পাকিস্তান এখনো বাংলাদেশে তাদের হত্যাকান্ডের জন্য ক্ষমা চাইনি। তবে পাকিস্তানের নিপীড়িত জনগণের জন্য আমাদের ভালোবাসা আছে।
ইতিহাসের ভবিষ্যত সেখানেই যেখানে ইতিহাসের অতীত স্মরণে থাকে।
আহ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : তুমি ইতিহাসের ভুল পথে নাকি তোমার ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ভবিষ্যৎই ভালো জানে।
শামশির শরিফ
লেখক ও গবেষক।