স্পর্ধা নিউজ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক:
শহীদ ছাত্রনেতা ডাঃ জামিল আকতার রতন রাষ্ট্রধর্ম বিল বাতিল ও মৌলবাদী রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবীতে
প্রথম প্রতিবাদী শহীদ।
পর্ব-১
আজ ৩১ মে’ ২০২৫।।
সালটা ১৯৮৮, তারিখ ৩১ মে’। ৩৭ বছর পার হয়ে গেলো।
জামিল আখতার রতন ভাইকে নিশ্চয়ই সবার মনে আছে। আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আমরা কেউ কি এক মুহূর্তের জন্যে ভুলতে পেড়েছি ? আমাদের সবার কাছেই এক দুর্বিষহ স্মৃতির একটা যন্ত্রণাদায়ক দিন। এখন শুধুই স্মৃতি।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি জামিল আখতার রতন ভাই, তখন পঞ্চম বর্ষের ছাত্র। সেই সময়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হয়ে উঠেছিলো সে সময়ের প্রগতিশীলতার প্রতীক। আর তারই মধ্যমণি ছিলেন দুর্দান্ত, মেধাবী, একনিষ্ঠ, বন্ধুপরায়ণ জামিল আখতার রতন। আজন্মবিপ্লবী এক যুবকের মুখে ছিল এক গভীর স্বপ্ন, শ্রেণীহীন, শোষণহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন। তাই তাঁকে ঘিরেই রাজশাহী মেডিকেল কলেজের প্রগতিশীল আন্দোলন আর সুস্থ ও সুষ্ঠ চিন্তার চর্চাকেন্দ্র। হয়তো সেকারণেই এই তীব্র আঘাতের টার্গেট করা হয় জামিল ভাইকে।
দলগতভাবে রাজশাহী মেডিকেল এ রেষারেষি থাকলেও কখনও খুন পর্যন্ত গড়ায় নাই। শিবির সমর্থক বেশী ছিল না। সব মিলিয়ে বড়জোর ৩০-৪০ জন ছাত্র। ৩০ মে, রাতে “ধর- ধর ” শব্দের পরেই শিবিরের সেই মিছিলে এসে জুটল শতাধিক লোক
, সবার হাতেই অস্ত্র। সেই অস্ত্র নিয়ে তারা সারারাত চালালো মধ্যযুগীয় মহড়া।
সকাল হতেই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ মিছিল নিয়ে অধ্যক্ষের কাছে স্মারক লিপি দিলো এবং অভিযোগ করলো, মেইন হোস্টেলের কলাপ্সিবল গেট বন্ধ করে অস্ত্রসহ শিবিরের অনেক বহিরাগত অবস্থান করছে। ততক্ষণে একাডেমিক কাউন্সিল এই উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে করণীয় কি, তার সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য নিয়ে মিটিংয়ে বসে গেছেন। ছাত্রদের অভিযোগ শুনে একাডেমিক কাউন্সিল সরেজমিনে গিয়ে অভিযোগের সত্যতা যাচাই করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই মিটিং থেকেই অধ্যক্ষ সহ প্রায় তিরিশ জন শিক্ষকের একটি দল মেইন হোস্টেলে যান। কয়েকজন ছাত্রের সঙ্গে জামিল ভাইও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। শিক্ষকরা যখন মেইন হোস্টেলে ঢুকতে যান, তখনই বাঁধা আসে সেখানে অবস্থানরত শিবিরের ক্যাডারদের কাছে থেকে। এর মধ্য থেকে কয়েকজন বহিরাগত শিক্ষকদের সাথে উদ্ধতভাবে তর্কে জড়িয়ে পড়ে।
এর মধ্যেই হঠাৎ এক তীব্র হুইসেলের শব্দ আর “নারায়ে তাকবীর” বলে শিবিরের শতাধিক অস্ত্রধারী গুণ্ডা শিক্ষকদের সামনেই কাপুরুষের মতো নিরস্ত্র জামিল ভাইকে ধাওয়া করে। এর পরে শিক্ষকদের সামনেই “নারায়ে তাকবীর” শ্লোগান দিয়ে নিরস্ত্র ছাত্রদের উপর শিবিরের অস্ত্রধারীরা ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিছু দূর দৌড়ে গিয়ে অস্ত্রের আঘাতে জামিল ভাই মাটিতে পড়ে যায়। আহত জামিলকে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা নিশ্চিত করে দুর্বৃত্তরা। মৃত্যু নিশ্চিত করে যখন হত্যাকারীরা ফিরে যাচ্ছিলো, তখন মৃত্যু যন্ত্রণায় জামিল একটু নড়ে ওঠে। তখন কয়েকজন আবারো ফিরে এসে তাকে কোপায় । খুনিরা মৃত্যু নিশ্চিত করে তারা তবে জায়গা ত্যাগ করে। জামিল ভাইয়ের রক্তাক্ত দেহ টা পড়ে থাকে মাটিতে।
এই হত্যাকাণ্ড ছিল অত্যন্ত পরিকল্পিত। স্বৈরাচার বিরোধী অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল রাজনীতির সবচেয়ে তীক্ষ্ণ নেতৃত্বকে সরিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার রাজনীতি ।
সবার সামনে দিবালোকে যেভাবে খুন হলেন, কেউ কিছুই করতে পারলেন না। এ ব্যর্থতা এখনও আমাদেরকে অপরাধী করে রেখেছে। ৩৭ বছর পার হয়ে গেছে । আজও তার কোন বিচার হল না। আজও খুনিরা দাপটে ঘুরে বেড়ায়। এই লজ্জা আমাদের। জামিল ভাই কি আমাদের ক্ষমা করতে পারবেন ??
জামিল ভাইয়ের সেই আত্মদান আজকের প্রজন্মের কাছে অবশ্যই হতে পারে এক অবিস্মরণীয় প্রেরণা। আজকের নতুন প্রজন্ম অনেকেই জানে না সেদিনের ঘটনা। জামাত-শিবির আজ নতুন নয়, বহু আগে থেকেই ওরা যেখানেই দেখেছে ভাল কিছু, সেখানেই হায়েনাদের মত করাল থাবায় আঘাত হেনেছে, ধ্বংস করতে চেয়েছে সমাজকে, দেশকে। আজও বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের আড়ালে সরকার পতন, স্বাধিনতা-মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন ধংশ করে চলেছে অবলিলায়, চরম অপমান করে চলেছে মুক্তিযোদ্ধাদের।
জামিল ভাই আমাদের স্মৃতিতে আছেন, স্মরনে আছেন, আমরা ভুলে যায়নি, ভুলবোনা। মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক ও স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির মূল উতপাটন করে একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্ম নিরপেক্ষ সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়েই জামিল ভায়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবো। অপেক্ষায় আছি। সেদিন আসবেই। তানাহলে ইতিহাস মিথ্যা হয়ে যাবে। তাই তাঁকে স্মরনে রাখি সব সময়।
বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী রাজশাহী মেডিকেল কলেজ শাখার তৎকালীন সভাপতি শহীদ ছাত্রনেতা জামিল আকতার রতনকে ১৯৮৮, তারিখ ৩১ শে মে। দল-মত নির্বিশেষে অনেকের কাছেই এক দুর্বহ স্মৃতির একটা দিন। ৩৭ বছর আগে এইদিনে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি ডা: জামিল আকতার রতনকে প্রকাশ্য দিনের আলোতে ৩৪/৩৫ জন শিক্ষকের সামনে কুপিয়ে হত্যা করে শিবিরের গুন্ডারা।
এ দিনটিকে বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীসহ অপরাপর ছাত্র সংগঠনসমূহ ‘মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী দিবস’ হিসেবে পালন করে। জামাত-শিবিরসহ সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদ-জঙ্গিবাদবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে তিনি রাজশাহীতে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন।
জেনারেল হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ সংবিধানের ৮ম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম প্রবর্তনের চেষ্টাকালে তার বিরুদ্ধে রাজশাহীতে তিনি দুর্বার ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাঁর রক্তের উপর দাঁড়িয়েই এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম প্রবর্তন করেন।
১৯৮৮ সালের ৩১ মে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গনে একাডেমিক কাউন্সিলের ৩৪ জন শিক্ষকের সামনেই ছাত্র শিবিরের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা তাকে গুলি করে ও কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। সেই থেকে এ দিনটিকে ছাত্র মৈত্রীসহ অপরাপর অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ছাত্র সংগঠনগুলো ‘মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে।
যা ঘটেছিলো
——————-
সাল ১৯৮৮, তারিখ ৩১ শে মে। দল-মত নির্বিশেষে অনেকের কাছেই এক দুর্বিসহ স্মৃতির একটা দিন। ৩৪ বছর আগে এইদিনে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি ডা: জামিল আকতার রতনকে প্রকাশ্য দিনের আলোতে ৩৪/৩৫ জন শিক্ষকের সামনে কুপিয়ে হত্যা করে শিবিরের গুন্ডারা।
জামিলের গত্যাকান্ড আর দশটা হত্যাকান্ডের মত নয়। আজকাল শিক্ষাংগনগুলোতে যে নিরন্তর ছাত্র সংঘর্ষ আর রক্তপাতের ঘটনা দেখি আমরা, জামিলের হত্যাকান্ড ঠিক সেগুলোর সাথে মিলানো যায়না। আজ বিশ্লেষন করলে বুঝা যায়, এই হত্যাকান্ডের পিছনে গভীর আর সুদুরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিলো, ছিলো কিছু ঘৃন্য ষড়যন্ত্র।
নব্বয়ের দশকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হয়ে উঠেছিলো সে সময়ের প্রগতিশীলতার প্রতিক, ছোটখাট গড়নের এক দুর্দান্ত মেধাবী ছাত্রনেতা জামিল আকতার রতন ছিলেন মধ্যমনি। আজন্ম বিপ্লবী জামিলের চোখে মুখে ছিলো এক গভীর স্বপ্ন, শ্রেনীহীন, শোষনহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন। তাকে ঘিরেই আবর্তিত হতো রাজশাহী মেডিকেল কলেজের প্রগতিশীল আন্দোলন আর চিন্তার চর্চা। হয়ত সে কারনেই এই তিব্র আঘাতের টার্গেট করা হয় জামিল আকতার রতনকে।
৩০ মে রাত ১৯৮৮।
ঘটনার সুত্রপাত হয় সে রাতেই। শিবির মিছিল করছে। এমন সময় অন্ধকারে কে বা কারা আওয়াজ তোলে ‘ধর ধর’। রাজশাহী মেডিকেল কলেজে কোনো সংগঠন মিছিল করলে কেউ ‘ধর ধর’ এমন সংস্কৃতি কখনো ছিলোনা।
একটা মেডিকেল কলেজে সব মিলিয়ে কয়েকশো ছাত্র থাকে। রাজনৈতিক রেষারেষি হয়ত থাকে, কিন্তু সেটা খুন পর্যন্ত গড়ানো সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে একটু অস্বাভাবিক ছিলো।
সে সময়ে রাজশাহী মেডিকেলে শিবির সমর্থন করতো সব মিলিয়ে ৩০/৪০ জন ছাত্র। এই ‘ধর ধর’ শব্দের পরেই শিবিরের সেই মিছিলে এসে জুটলো শতাধিক লোক, সবার হাতেই অস্ত্র। সেই অস্ত্র নিয়ে তারা সারারাত চালালো মধ্যযুগীয় মহড়া।
সকাল হতেই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ মিছিল নিয়ে অধ্যক্ষের কাছে স্মারকলিপি দিলো এবং অভিযোগ করলো, মেন হোস্টেলের কলাপসিবল গেট বন্ধ করে অস্ত্রসহ শিবিরের অনেক বহিরাগত অবস্থান করছে। ততক্ষনে একাডেমিক কাউন্সিল এই উত্তেজকর পরিস্থিতে করনীয়, তার সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য শিক্ষকদের নিয়ে মিটিংয়ে বসে গেছেন। সেই মিটিং থেকেই অধ্যক্ষ্য সহ ৩৫ জন শিক্ষকের একটি দল মেইন হোস্টেলে যান। কয়েকজন ছাত্রের সংগে জামিল আকতারও ছিলেন।
শিক্ষকরা যখন মেইন হোস্টেলে ঢুকতে যান, তখনই বাধা আসে অবস্থানরত শিবিরের ক্যাডারদের কাছ থেকে। এর মধ্যথেকে কয়েকজন বহিরাগত শিক্ষকদের সাথে উদ্ধতভাবে তর্কে জড়িয়ে পড়ে। জামিল আকতার সেই বহিরাগতদের দেখিয়ে বলেন, “ঐ দেখুন স্যার বাইরের লোক”।
এর মধ্যেই হঠাত এক তিব্র হুইসেলের শব্দ আর ” নারায়ে তাকবির” বলে শিবিরের শতাধিক গুন্ডা শিক্ষকদের সামনেই কাপুরুশের মত নিরস্ত্র জামিল আকতার রতনকে ধাওয়া করে, কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে।
এর পরের অংশ জানুন একাডেমিক কাউন্সিলের বিবৃতি থেকে:
বিবৃতি
———
জামিল আকতার রতনের হত্যাকান্ডের ব্যাপারে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের একাডেমিক কাউন্সিল এক বিবৃতি দিয়েছে, এতে বলা হয়, প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে ;- ” ৩১শে মে বেলা আনুমানিক ১১টায় কলেজের সাধারন ছাত্র-ছাত্রী মিছিল সহকারে একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় এসে অভিযোগ করে, ইসলামি ছাত্র শিবিরের ছত্র-ছায়ায় একদল বহিরাগত অস্ত্রশস্ত্র সহ প্রধান ছাত্রবাসে পশ্চিম উত্তর ব্লকে অবস্থান করছে এবং কলেজে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। তখ একামেডিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, কাউন্সিলের সদস্য, ও অন্যান্য শিক্ষক অবস্থা দেখার জন্য ছাত্রবাসে যান। ছাত্রবাসে দুটি ব্লক দেখে পশ্চিম উত্তর ব্লকে যাবার সময় কিছু ছাত্র তাদের বাধা দেয়। এদেরকে ইসলামী ছাত্র শিবিরের সদস্য ও সমর্থক বলে চিহ্নিত করা হয়।যারা বাধা দেয় তারা দাবী করে যে তাদের প্রত্যকের ৫ জন করে অতিথি আছে এবং কোন মতেই ঐ ব্লক পরিদর্ষন করা যাবেনা।
এরপর সেদিকে যাবার সময় তারা বাঁশী বাজিয়ে, “নারায়ে তাকবির” শ্লোগান দিয়ে মারাত্ব অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বেরিয়ে এসে নিচে দন্ডায়মান সাধারন ছাত্রদের ধাওয়া করে। ঐ অবস্থায় জামিল আকতার রতন নামে ৫ম বর্ষের একজন ছাত্রকে মারাত্বক ভাবে আহত করে। তাকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়ার পরসে মারা যায়। ছাত্রাবাস থেকে আসার সময় ঐ শিবিরের উশৃংখল হামলাকারীরা আবার বাধা দেয়। এ সময় গাড়ী ভাংচুর এবং বোমা নিক্ষেপ করা হয়।”
২রা জুন দৈনিক সংবাদে জামিল হত্যার প্রতিবাদে, বিভিন্ন বিভিন্ন কর্মসুচির শেষে প্রকাশিত হয় সেই বিবৃতি।
(চলবে)
হাফিজ সরকার
সাবেক ছাত্র নেতা,
লেখক ও কলামিস্ট
তথ্যসুত্রঃ
১) গোয়েন্দা প্রতিবেদন-দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।
২) শংকর কুমার দের গবেষণা প্রতিবেদন।
৩) ২রা জুন ১৯৮৮ দৈনিক সংবাদে জামিল হত্যার প্রতিবাদে, বিভিন্ন বিভিন্ন কর্মসুচির শেষে প্রকাশিত হয় সেই বিবৃতি।