স্পর্ধা নিউজ প্রতিদিন। অনলাইন ডেস্ক ।।
বাংলাদেশের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ শুধু একটি সামরিক বা রাজনৈতিক ঘটনা নয়, বরং জাতির অস্তিত্বের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে থাকা এক সংগ্রাম। এই সংগ্রামের প্রতিটি স্তম্ভ—সামরিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, কূটনৈতিক—সমান গুরুত্বপূর্ণ। অথচ বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০২৫’ নামে একটি অধ্যাদেশ জারি করে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনার যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তা সর্বমহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া ও আলোড়নের জন্ম দিয়েছে।
নতুন সংজ্ঞা অনুযায়ী, যারা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সরাসরি সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, শুধুমাত্র তারাই ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন। অন্যদিকে, যাঁরা যুদ্ধের সময় সাংস্কৃতিক, কূটনৈতিক, তথ্য-প্রচারণা বা রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন—যেমন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা বা মুজিবনগর সরকারের কর্মী—তাঁদের ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হবে।
এই ঘোষণার পরপরই রাজনৈতিক মহল, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সংগঠন ও সাধারণ জনগণের মধ্যে বিতর্কের ঝড় ওঠে। অনেকেই মনে করেন, এই সিদ্ধান্ত মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিকতা ও অন্তর্নিহিত তাৎপর্যকে সংকুচিত করছে। মুক্তিযুদ্ধ একটি বহুমাত্রিক সংগ্রাম ছিল, যেখানে কেবল বন্দুকধারীরাই নয়, একজন কবি, শিল্পী, ফুটবল খেলোয়াড় কিংবা রেডিও ঘোষকও ছিলেন যুদ্ধের সম্মুখসারির যোদ্ধা। সেইসব অবদানকে ‘সহযোগী’ আখ্যায়িত করে মূল ইতিহাস থেকে আলাদা করে দেওয়ার চেষ্টা অনেকের দৃষ্টিতে একটি ঐতিহাসিক অবমূল্যায়ন।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি এই অধ্যাদেশকে “পরিকল্পিত চাতুরিপনা, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ও ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টা” হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছে, একটি অনির্বাচিত সরকারের পক্ষে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো নৈতিক অধিকার নেই। তাদের ভাষায়, এই সরকার মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির প্রভাবে পরিচালিত এবং এর উদ্দেশ্য হলো মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও আদর্শকে ধ্বংস করা। তারা আরও উল্লেখ করে যে, অধ্যাদেশে বঙ্গবন্ধুর নাম ও ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ শব্দবন্ধ বাদ দিয়ে একটি নিরপেক্ষ কাঠামো দাঁড় করানোর মাধ্যমে ইতিহাসের রাজনৈতিক ভিত্তিকে অস্বীকার করা হয়েছে।
অধ্যাদেশে ‘সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা’ নামে যে শ্রেণিবিভাজন তৈরি করা হয়েছে, তা ভবিষ্যতে মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে গৌণ করার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। একদিকে সম্মুখযোদ্ধা আর অন্যদিকে সহযোগী হিসেবে এমন বিভাজন জাতিকে বিভ্রান্ত করবে এবং মুক্তিযুদ্ধের একক জাতীয় ঐতিহ্যকে দুর্বল করবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
ওয়ার্কার্স পার্টি তাদের বিবৃতিতে স্পষ্ট করে বলেছে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে এই দেশের মানুষ ২৫ বছরের গণসংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে একটি গণযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। ৩০ লক্ষ শহীদ, ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি, কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে দেশের বাইরে আশ্রয় গ্রহণ, অসংখ্য মানুষের মৃত্যুঝুঁকি, দারিদ্র্য, বন্দিত্ব—সবই মুক্তিযুদ্ধের অংশ। সেই যুদ্ধের পক্ষেই দাঁড়ানোই ছিল একজন মুক্তিযোদ্ধার পরিচয়।
মুক্তিযোদ্ধা কেবল একজন যোদ্ধা নন—তিনি একজন চিন্তাশীল, সাহসী, দেশপ্রেমিক ব্যক্তি, যিনি জাতির অস্তিত্ব রক্ষায় নানা পথে লড়েছেন। তার অবদান কোনো আইনি সংজ্ঞায় সীমাবদ্ধ নয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধ কেবল অতীতের এক অধ্যায় নয়—এটি আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশক। সেই ইতিহাসকে বিভাজনের হাতিয়ার না বানিয়ে, সম্মিলনের ভিত্তি হিসেবে দাঁড় করানোই হবে একটি সচেতন ও দায়িত্বশীল জাতির পরিচয়। সময় এসেছে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা রক্ষায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তির ঐক্য গড়ে তোলার।
লেখকঃ
আহাদ মিনার
একজন প্রগতিশীল কর্মী,
লেখক ও গবেষক।