স্পর্ধা নিউজ প্রতিদিন।। উপসম্পাদকীয় ।।
সম্প্রতি চীনের কুনমিংয়ে ষষ্ঠ চীন- দক্ষিণ এশিয়া কো-অপারেশনের সভায় এক সাইডলাইন বৈঠকে তিন দেশের কর্মকর্তারা ত্রিপক্ষীয় জোট বা কো-অপারেশন গড়ে তোলার বিষয়ে সম্মত হয়। চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দপ্তর বৈঠকের বিষয়টা নিশ্চিত করেছে। কোনো উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক না হলেও এই ঘোষণার গুরুত্ব রয়েছে বলে অনুমান হয়। এই তিনটি দেশের মধ্যে চীন – পাকিস্তান সম্পর্ক অত্যন্ত গাড়। তাদের রয়েছে অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক। পাকিস্তানের রাজনীতিতে চীনের নিরব সমর্থন, সরব অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক রয়েছে। পাকিস্তানে চীনের বিনিয়োগ বর্তমানে একটা জটিল সময় পার করছে, বিশেষ করে বালুচিস্তানে। অন্য দিকে, বাংলাদেশের সাথে চীনের একটি কার্যকর সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সম্প্রতি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নতি করছে। এখনো তা সামরিক রাজনৈতিক ভ্রমণে সীমাবদ্ধ আছে। বেশিদূর এগোয়নি। কিন্তু চীন বাংলাদেশের সাথে তার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে ত্রিপাক্ষিকএ উন্নীত করতে চাইছে কেনো? বাংলাদেশও তাতে সায় দিচ্ছে কেনো?
ঐতিহাসিকভাবে দেখলে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান চীন বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবারও রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটলে চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় এবং একটা স্বাভাবিক সম্পর্কে আসে। সেই সম্পর্কের পঞ্চাশ বছর পূর্তি হলো এই বছর। পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক নানা টানাপোড়েনের মাধ্যমে এত বছর এগিয়েছে এবং এতে অনেক প্রশ্ন এখনো অমীমাংসিত আছে।
সাম্প্রতিক বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে চীনের সাথে সম্পর্ক একটু হোচট খেলেও তা সামলে উঠছে। চীন স্ব প্রণোদিত হয়ে বিএনপি এবং জামাতের প্রতিনিধিদের বেইজিং ভ্রমণ করিয়েছে। রাজনীতিতে ভারতবিরোধী মনোভাব তীব্র হলে চীন সেই সুযোগ কাজে লাগাবে সেটা স্বাভাবিক। আর এটা প্রধান উপদেষ্টার চীন ভ্রমণের সময় একটা উচ্চতায়ও পৌঁছেছে। কিন্তু চীন কি এখনো নিশ্চিত হতে পারছে না? আমার মনে হয়, চীনের স্বস্তি এখনো আসেনি। তার একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বার্মা অ্যাক্ট বা আরাকান পলিসি চীনের জন্য বড় হুমকি হয়ে দেখা দেবে। এছাড়া, বাংলাদেশে শুধু ভারত নয়, চীনের প্রভাবও যুক্তরাষ্ট্র মেনে নিচ্ছে না। কারণ এশিয়া প্যাসিফিকে চীনের বেল্ট এন্ড রোড প্রকল্পের ঘোর বিরোধী যুক্তরাষ্ট্র। এবং এখানে চীন কিছুটা চাপেও আছে। বাংলাদেশের ভূঅর্থনেতিক প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগের সরাসরি বিরোধিতা করছে যুক্তরাষ্ট্র। আর এসব বিবেচনা নিয়েই কি চীন তার পুরনো ও বিশ্বস্ত মিত্র পাকিস্তানকে বাংলাদেশের সাথে জোটে টানছে?
আমার মনে হয়, এখানে তিন দেশের আগ্রহ মিলেছে, বাংলাদেশ ভারতের বলয় থেকে বের হয়ে আসতে চায়, তাই তার দরকার চীনকে। অন্যদিকে বাংলাদেশ এখন ভারতবিরোধী রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক রাখতে চায়।
পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে চায়। আর চীন এই দুই দেশের চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চোখকে ফাঁকি দিতে চায়।
ঘোষণায় তিন দেশই বলেছে, এই জোট তৃতীয় কোনো দেশের বিরুদ্ধে নয়। তাহলে তারা কাকে আস্বস্ত করতে চায়? ভারত নাকি যুক্তরাষ্ট্রকে?
সর্বোপরি সব পর্যালোচনা করলে অনুধাবন করা যায় চীন এই জোটকে রাজনীতির স্বার্থে ব্যবহার করবে। আর বাংলাদেশের অর্থনীতিকে দেবার মতো পাকিস্তানের তেমন কিছু নেই। যাইহোক, মজার বিষয় হলো, পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ঢাল হিসেবে তেমন কার্যকর নয়, চীনের রাজনীতি ছাড়া অন্য কোনো কাজে লাগবে না। চীন বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা সংকটে কোনো কার্যকর সহায়তা করেনি তারা শুধু বাংলাদেশে বিনিয়োগেই আগ্রহী। তাই তারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে বেইজিং ভ্রমণ করাচ্ছে এবং পাকিস্তানকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। কিন্তু বাংলাদেশ যতই চীনের কাছাকাছি যেতে চাক না কেন তা যদি যুক্তরাষ্ট্রের চীন- মিয়ানমার নীতির বিরুদ্ধে যায় তবে বাংলাদেশকে তারা নতুন জটিলতায় ফেলবে। তাই, বাংলাদেশ উচিত হবে এই ধরনের জোটের চেয়েও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ও নিজের স্বার্থের দিকে নজর দেওয়া। চীন পাকিস্তানের রাজনীতি বাংলাদেশের উন্নয়নে তেমন কোনো কাজে আসবে না।
শামসির শরিফ।।