স্পর্ধা নিউজ প্রতিদিন।। অনলাইন ডেস্ক।।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে কিছু মানুষ আছেন যারা ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে জীবনভর শ্রমিক, কৃষক ও মেহনতী মানুষের জন্য লড়েছেন। তাঁদের কণ্ঠস্বর শক্তিশালী, যুক্তিনির্ভর এবং আপসহীন হওয়ায় ক্ষমতার রাজনীতির কাছে তাঁরা অনেক সময়ই অস্বস্তিকর হয়ে ওঠেন। এমনই এক নেতা রাশেদ খান মেনন—বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি, বাম রাজনীতির অন্যতম পুরোধা।
তার জীবনের ওপর একের পর এক হামলা, ষড়যন্ত্র ও কারাবাস প্রমাণ করে—একজন মানুষকে চুপ করানো সম্ভব হলেও, তার বলা সত্যকে থামানো যায় না।
১৯৯২ সালের ১৭ আগস্ট তোপখানা রোডে ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে একমাত্র বামপন্থী সংসদ সদস্য জননেতা মেননের ওপর সন্ত্রাসীরা গুলি চালায়। ওই সময় তাঁর রাজনৈতিক সক্রিয়তা ছিল চূড়ান্ত পর্যায়ে—শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ে বিভিন্ন আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। এবং সোচ্চার ছিলেন দেশ বিরোধীদের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে বিদেশে নিয়ে যাওয়া হয়। দীর্ঘ চিকিৎসা শেষে তিনি আবার দেশে ফিরে আসেন।
ফিরে এসে মেনন আগের মতোই রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। আঘাত তাঁকে থামাতে পারেনি—বরং আন্দোলন ও সংসদে তাঁর কণ্ঠ আরও দৃঢ় হয়।
২০০৮ থেকে ২০২৪—প্রায় ১৬ বছর সংসদে রাশেদ খান মেনন ছিলেন এক বিরল উদাহরণ।
তিনি আওয়ামী লীগের মিত্র হয়েও সরকারের ভুলত্রুটি, দুর্নীতি ও অবিচারের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন।
দুর্নীতি, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, ব্যাংক লুট, দখলদারিত্ব, সরকারি সম্পদের অপব্যবহার, বাজার ব্যবস্থা, নিত্যপণ্যের দাম—সব ক্ষেত্রেই তিনি কঠোর সমালোচনা করেছেন।
সংসদে সেন্টমার্টিন দ্বীপ নিয়ে প্রথমবার জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন উত্থাপন করেন তিনিই।
শ্রমিক অধিকার, ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি, শিল্পাঞ্চলে নিরাপত্তা, কৃষকদের ন্যায্যমূল্য—এসব বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে প্রস্তাব ও বক্তব্য রেখেছেন।
যুক্তরাষ্ট্র সাধারণত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সরাসরি কোনো ব্যক্তিকে উদ্দেশ করে প্রতিক্রিয়া জানায় না। কিন্তু মেননের বক্তব্য এতটাই প্রভাব ফেলেছিল যে, এক পর্যায়ে মার্কিন দূতাবাস তাঁর মন্তব্যের সরাসরি জবাব দেয়। এবং এখন সেই সেন্টমার্টিনে প্রবাল রক্ষার নামে জনসাধারণের প্রবেশ সংকুচিত করা হয়েছে। অন্ধকারে অনেক কথা চালু আছে যার সারাংশ প্রতিদিন খবরের কাগজে স্থান করে নেয়
এটি প্রমাণ করে—তাঁর কণ্ঠস্বর শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও গুরুত্বের সাথে আলোচিত হয়, চিন্তার খোরাক যোগায়।
চৌকস রাজনীতিবিদ
মেননের জনপ্রিয়তা, আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা ও আপসহীন অবস্থান অনেকের জন্যই অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে।
অহংকারি শেখ হাসিনা সরকারের পতনের সাথে সাথে হঠাৎ করেই মেননকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযোগের ভিত্তি দুর্বল, কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য স্পষ্ট—শ্রমিক-কৃষকের কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করা।
প্রায় এক বছর ধরে তিনি কারাগারে আছেন। এই বন্দিত্ব শুধুমাত্র একজন ব্যক্তিকে আটক করা নয়—এটি একটি রাজনৈতিক মতাদর্শকে থামানোর চেষ্টা।
যে কেউ হাসিনা সরকারের গত ১৬ বছরের জাতীয় দৈনিকের খবর ঘাটলে দেখতে পাবেন—মেনন সংসদে ও রাজপথে ধারাবাহিকভাবে সরকারের সমালোচনা করেছেন, বিকল্প নীতি প্রস্তাব করেছেন, শ্রমজীবী মানুষের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার ছিলেন।
এই ধারাবাহিক সমালোচনা ও আন্দোলনই তাঁকে ক্ষমতাসীনদের কাছে ‘অস্বস্তিকর’ করে তুলেছে।
মেননের মুক্তি কেন জরুরি-
একজন সংসদ সদস্য ও জাতীয় নেতা অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে তাঁকে কারাবন্দি করা মানে রাজনৈতিক স্বাধীনতা খর্ব করা।
মেনন শুধু রাজনৈতিক নেতা নন—তিনি মেহনতী মানুষের প্রতিনিধি। তাঁর অনুপস্থিতি মানে তাঁদের কণ্ঠস্বর অনুপস্থিত।
মিথ্যা মামলা ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা যদি বিচারব্যবস্থায় স্থান পায়, তবে তা গণতন্ত্রের জন্য ভয়াবহ সংকেত।
রাশেদ খান মেননের মুক্তি শুধু একজন ব্যক্তির মুক্তি নয়—এটি শ্রমিক, কৃষক, প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠস্বর ফিরিয়ে আনার লড়াই।
যে কণ্ঠস্বর ১৭ আগস্টের গুলিতে থামেনি, দীর্ঘ চিকিৎসার কষ্টেও থামেনি, সংসদের চাপে চুপ করেনি—তাকে কারাগারের দেয়ালে আটকে রাখা যায় না।
আমরা বার বার বলতে চাই-
মেননের মুক্তি মানে সত্যের মুক্তি।
মেননের মুক্তি মানে মেহনতী মানুষের মুক্তি।